একজন মানবিক মানুষ হিসেবে আমি অবশ্যই উনাদের পাশে থাকবো, উনাদের সংগ্রামকে সমর্থন জানাবো- কানিজ ফাতেমা
আদিবাসী নির্যাতন এবং আমার ভাবনা শীর্ষক পোস্টের পর ইনবক্সে আসা বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার উত্তর দিলেন কানিজ ফাতেমা:-
গতপরশু আদিবাসী নির্যাতন নিয়ে এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমর্থনে একটা পোস্ট করেছিলাম। সেই পোস্টটা করার পর আমার শ্রদ্ধাভাজন এক বড় ভাই একটা মন্তব্য করেন। বলেছিলাম এর উত্তর দিতে গেলে অনেক বড় করে সময় নিয়ে লিখতে হবে। পরবর্তিতে ইনবক্সেও অনেকেই একই ধরণের কিছু প্রশ্ন কিংবা মন্তব্য করেন। আজ একটু সময় পাওয়ায় লেখাটা শেষ করলাম। প্রায় সমগোত্রীয় প্রশ্ন কিংবা মন্তব্য অনেকেই করায় একই সাথে সকলের মন্তব্যের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছি। শুধু যে যারা মন্তব্য কিংবা প্রশ্ন করেছেন তারাই আদিবাসী ইস্যুতে এইরকম করে ভাবেন তা নয়, আদিবাসী ইস্যুতে মোটামুটি সকল বাঙালি একই ধরণের মনোভাব পোষণ করায় উত্তরটা বিস্তারিত ভাবে আলাদা লেখার প্রয়োজন অনুভব করছি।
মন্তব্য ১ঃএক হাতে তালি বাজে না, আদিবাসীদেরও দোষ আছে।
এক হাতে তালি বাজে না এটা একটা খুবই অমানবিক কথা। যেই শিশু মেয়েটা ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তাকে যখন বলা হবে এক হাতে তালি বাজে না, তারও দোষ আছে, সেটা তাকে এবং পুরো মানব জাতিকেই কড়াভাবে অপমান। আমরা ফিলিস্তিনে মানুষ মারতে দেখেছি, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মারতে দেখেছি, সেখানেও কি আপনি বলেন, এক হাতে তালি বাজে না? সেখানে কিন্তু ঠিকই বাঙালি মুসলমানের মানবতা বের হয়ে আসে। খালি অমুসলিম হলে মনে হয়, এক হাতে তালি বাজে না। ব্যাপারটি দুঃখজনক এবং হতাশাজনক। আপনার শিশু কন্যাটি রেইপড হওয়ার পরে যখন কেউ এসে বলবে, এক হাতে তালি বাজে না, তখন বুঝবেন এসব কথা কতটা অমানবিক।
এখন আসি যদি কোনও আদিবাসী অপরাধ করেও থাকেন তবে আমরা এই ইস্যুতে তার গোত্রের সবার উপর হামলে পড়তে পারি কিনা। অপরাধী সব গোত্রেই আছে। আদিবাসীদের মধ্যেও চোর ডাকাত খুনী ধর্ষক থাকতে পারে। যখন যে অপরাধ করবে তখন তার বিরুদ্ধে আপনি আইনী ব্যবস্থা নিতে পারেন এবং এটাই সভ্য আচরণ। কেউ একজন আপনাকে আঘাত করেছে, সেটার জন্য উক্ত আসামীর বিচার হবে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী। যখনই আপনি ব্যক্তি বাদ দিয়ে তার গোত্রের উপর ঝাপিয়ে পড়লেন, এর উদ্দেশ্য তো পরিষ্কার। বাঙালি কোনও অপরাধীর বেলায় তো একই কাজ করবেন না, তাই না? আদিবাসীদের আপনি দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করছেন এবং তাদের শোষণ ও নীপিড়ন করার সার্টিফিকেট রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাপ্ত হয়েছেন। তাই তাদের সাথে আপনার আচরণ ঠিক পশ্চিম পাকিস্তানি প্রভুদের তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানী বাঙালিদের প্রতি যেমন ছিলো এমনই বৈষম্যমূলক।
মন্তব্য ২ঃ পাহাড়ে সেটেলররা বসবাস করলে আদিবাসীদের সমস্যা কী? পাহাড় কি তাদের বাপের সম্পত্তি?
আদিবাসীরা যুগযুগ ধরে সেখানে বসবাস করছে। সেটা তাদের জমি, তাদের ভূমি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আদিবাসীরা বসবাস করতো। লক্ষ লক্ষ ইউরোপীয় খুনী ডাকাত ধর্ষককে শাস্তি হিসেবে আমেরিকা পাঠিয়ে দিতো ইংল্যান্ডের রাণী। সেইসব লোক সেখানে গিয়ে বসবাস করতে লাগলো, এবং একটা রাষ্ট্র গঠন করলো। কিছুদিন পরে সেই রাষ্ট্র গঠন করে তারা সমস্ত জমির অধিকার নিয়ে নিলো। জমির দলিল বানালো, জমির মালিকানা তৈরি করলো। সেই রাষ্ট্রে সেইসব আদিবাসীদের কোন জমির অধিকার আর রইলো না। কীভাবে থাকবে, আদিবাসীরা তো ওইসব আইন বানায় নি। তারা তো ঐ সব দলিল দস্তাবেজ বোঝে না। তারা শত শত বছর ধরে সেখানে সুখে শান্তিতেই বসবাস করতো। উড়ে এসে জুড়ে বসা কিছু লোক বানাতে শুরু করলো নিত্য নতুন আইন, নিত্য নতুন আইন জাড়ি করে তারা দখলে নিতে লাগলো ভূমি। যা ছিল আদিবাসীদের।
আইন, রাষ্ট্র, বা সরকার এখন পৃথিবী কোন সভ্য দেশেই এভাবে ভূমির অধিকার নিয়ে নিতে পারে না। আইন করে, দলিল দেখিয়ে আর ভূমি কেড়ে নেয়া যায় না মানবিক বিশ্বে। যারা ভূমিতে বসবাসকারী, তারাই ভূমির মালিক। এটা আমার কথা নয়, আদিবাসীদের যেই মানবাধিকার সনদ সেখানেই স্পষ্ট করে বলা আছে। সরকার বা রাষ্ট্র বা সংখ্যাগুরুরা সেই জমি কোনও দলিল দেখিয়ে বা ক্ষমতা প্রয়োগ করে দখলে নিতে পারে না। কেউ যদি আদিবাসীদের জমি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ না মেনে দখল করে, আদিবাসীদের প্রতিবাদ করা উচিত এবং সেখানের বাঙালি সেটেলারদের উচ্ছেদ করা উচিত।
মন্তব্য ৩ঃ আদিবাসীরা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চাইলে আমরা বাঙলাদেশী হিসেবে কিভাবে এটা সমর্থন করি?এটা তো পরিষ্কার দেশদ্রোহী আচরণ।
আমরা যখন পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে পৃথক বাঙলাদেশ গঠন করতে চেয়েছি পাকিস্তানি অনেক বিবেকসম্পন্ন মানবিক মানুষ আমাদের সমর্থন দিয়েছে। মানবিক হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে নিজের জাতিসত্তা ও ধর্মপরিচয়ের উর্ধ্বে যেয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণ অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং নীপিড়িত ও শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তখন পশ্চিম পাকিস্তানি সেইসব মানবিক মানুষের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদোহীতার অভিযোগ উঠেছিলো, রাষ্ট্র কর্তৃক নীপিড়িত হতে হয়েছিলো। তারপরও তারা বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন জানিয়ে গেছেন। সুতরাং আমাকে প্রশ্ন না করে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন নীপিড়িত শোষিত মানুষকে সমর্থন দিবেন নাকি আজাইরা ফালতু অমানবিক থার্ডক্লাস জাতীয়াতাবাদী চেতনা ধারণ করে রাষ্ট্রের সুনাগরিক সেজে বসে থাকবেন। আমি আবারও বলছি জাতীয়তাবাদের ধারণা সভ্য রাষ্ট্রগুলোয় পুরাতন, বাতিল এবং অসভ্য ধারণা। এইসব ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী পরিচয় ঝেড়ে ফেলে মানবিক হওয়াই আধুনিক সভ্য সমাজের দর্শন।
আমরাও চাই না আমাদের পার্বত্যচট্টগ্রাম, আমাদের দেশের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী আমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাক। কিন্তু যখন রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে দিনের পর দিন আদিবাসীরা অত্যাচারিত ও নীপিড়িত হবে তখন আদিবাসী জনগোষ্ঠী যদি তাদের অধিকার আদায়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে চায়, একজন মানবিক মানুষ হিসেবে আমি অবশ্যই উনাদের পাশে থাকবো, উনাদের সংগ্রামকে সমর্থন জানাবো।
বি:দ্র: অননুমোদিতভাবে ছবি এবং পোস্ট ব্যবহারের জন্য কর্তৃপক্ষ দু:খ প্রকাশ করছে!
No comments: